আমরা কবিতা আবৃত্তি করতে ভালোবাসি, গান শুনে মৌন হই, গল্পের চরিত্রের মাঝে হারিয়ে যাই। অতীত শিল্পীর স্বযত্নে গড়ে তোলা ভাস্কর্য দেখে আমরা আপ্লুত হই। আমরা মানুষরা শিল্প সাহিত্যের চর্চা করে আসছি সেই আদিম কাল থেকে। একজন শিল্পীর হৃদয়ের যত আকুতি, যত মাধুর্য- তার সবটাই সে ঢেলে দেয় তার সৃষ্টিকর্মে। একজন সৃষ্টিশীল মানুষ শুধুই তার হৃদয়ের কথা শোনে। শিল্পীর হৃদয়ের যত আর্তি, যত তৃষ্ণা- এর সবটুকু সে মেটাতে চায় তার সৃষ্টিকর্মে। শিল্পীর সৃজন আমাদের মুগ্ধ করে, আমরা শিল্পীর সৃষ্টিকর্মে মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ি; মনের অজান্তেই বারবার শিল্পীর প্রশংসায় কথার-মালা সাজাই।
একজন কবি কবিতায় শুধু নিছক কিছু বুলিই আওড়ায় না, কবি তার অনুভূতির ব্যাপ্তি প্রকাশ করে তার কবিতায়। কবি তার চিন্তা, তার জীবন-দর্শন উপস্থাপন করে পঙতিমালায়। কবি যখন কবিতা লেখে- সে কোনো গ্রামারের ধার ধারে না। কবিতার যে ছান্দসিকতা- তা কবির একান্তই নিজস্ব প্যাটার্ন। যে কবি অন্যের অনুসারী, সে কখনো মৌলিক কবি হয়ে ওঠে না। কবির অন্তর্জগৎ যদিও বা কবিতায় কিছুটা প্রকাশ পায়- তা কখনো কবির অন্তঃসারকে পুরোপুরি ধারণ করতে পারে না।
আমরা সুপ্রাচীনকাল থেকেই গল্প শুনতে ভালোবাসি। অতীতের মিথোলজি, রূপকথার গল্প, লোককথা; বর্তমানের জীবনবাদী গল্প, আমাদের নিজেদের গল্প কিম্বা ভবিষতের গল্প, সায়েন্স ফিকশন - এসব গল্পগুলো আমাদের টানে। আমরা এসব গল্পে যেন নিজেদের খুঁজে বেড়াই, গল্পের নায়কের সাথে বারবার নিজেকে মেলাই, গল্প থেকে অনুপ্রেরণা খুঁজি! ছোট্টবেলায় দাদীমা'রা যখন রাক্ষস-খোক্ষসের গল্প বলতেন- আমরা চোখ বড়বড় করে চেয়ে থাকতাম, মনোযোগ দিয়ে শুনতাম, কখনো চমকে উঠতাম। এরপর বড় হয়ে কখনো ডুবে যেতাম শীর্ষেন্দুতে, কখনো হুমায়ুনে, কখনো সমরেশে। জে.কে. রাওলিং -এর জাদুর জগত কিম্বা স্টিফেন কিং এর হরর- সবক'টাই কৈশোরে মননকে মাতিয়ে রাখতো।
মিউজিক কিম্বা গানের মুর্ছনায় মাতোয়ারা হয় না- এমন কেউ বোধহয় নেই। গান আমাদের কখনো কাঁদায়, কখনো হাসায়, কখনো ভালোবাসায়। গানের কথায় আমরা হারিয়ে যাই। গান আমাদের ভাবতে বাধ্য করে, বিশ্বাস করায়। গানের প্রভাব চিন্তার জগৎ ছাড়িয়ে সরাসরি আত্মায় গিয়ে পৌঁছে। মন খারাপের মূহুর্তে একটা গান যেন মনকে নিমিষেই ভালো করে দিতে পারে; কিম্বা মনের অজান্তেই হৃদয়ের হাহাকারকে গভীর থেকে গভীরতম স্তরে পৌঁছে দিতে পারে।
একজন শিল্প-সাহিত্য ভক্ত মানুষ কিছুটা অস্থির চিত্তের হয়। একজন শিল্পী-সাহিত্যিক যখন তার শিল্প কিম্বা সাহিত্যের মাধ্যমে নিজের অনুভূতিগুলো গনমানসে পৌঁছায়- তখন সেখানে শুধু অনুভূতিই থাকে না; বরং কিছু চিন্তার আবেশ থাকে, দর্শনের রেশ থাকে৷ কোন এক শিল্পীর গড়া নগ্ন ভাস্কর্যকে আমাদের খুব একটা অশ্লীল মনে হয় না, বরং নগ্নতাকে কেমন যেন শৈল্পিক মনে হয়। কবির মনের অবিশ্বাসে আমরা যেন সমগ্র মানবের মানসকে খুঁজে পাই। গানেগানে সুরেসুরে কোন কথা যখন আমাদের মননে পৌঁছে- তখন সেগুলো আর নিছক বিনোদন থাকে না, বরং সেসবে আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করি। সমাজের অনেক অসৎ মানুষ মহৎ চরিত্র হয়ে ওঠে গল্পকারের ভাষ্যে।
আমরা গান, কাব্য, গল্পে যত বেশি মুগ্ধ হতে শুধু করি- জগতের অন্তঃসার আমাদের কাছে ততই লুপ্ত হতে থাকে। ধর্মাচারও সাহিত্যের নিছক উপজীব্যে পরিণত হয়। আমরা লালনের গানে আধ্যাত্মিকতার সন্ধান করতে শুরু করি; কিম্বা অন্য কোনো মরমী কবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গাই- "দিন-দুনিয়ার মালিক খোদা, দিলে কি দয়া হয় না, তোমার দিলে কি দয়া হয় না..." অথবা "নামাজ আমার হইলো না আদায়, আল্লাহ..."। ...সত্যিই আমাদের নামাজ আর আদায় করা হয়ে ওঠে না।
কুর'আন আর পড়া হয় না। তাই কুর'আনের প্রভাবও আমাদের হৃদয়ে পৌঁছে না। মাঝেমাঝে মাসে কিম্বা ছ'মাসে এক'দু-দিন হঠাৎ আত্মা কেঁদে উঠলে আমরা অনুবাদ কুর'আন নিয়ে বসি। আরবি অনেকদিন না পড়ার কারণে আমরা অনেকে এখন কুর'আন আরবিতে পড়তেও ভুলে গেছি। তাই অনুবাদ থেকে কিছু পড়ার চেষ্টা করি; কিন্তু একসময় বিরক্ত হয়ে উঠে পড়ি, মনে হয়- 'আরেহ, এর সবই তো আমাদের জানা কথা।'
এরপর কী হয়? আমরা আমাদের সেই ইহমোহগ্রস্থ শিল্প-সাহিত্যে ফিরে যাই। হৃদয়টা ধীরে ধীরে পাথর হতে থাকে, যেখানে বিচ্ছিন্ন কিছু অনুভূতি থাকে, কিন্তু অনুভূতির একতা থাকে না। হৃদয়ের চাপা কষ্টগুলো মুক্তি খোঁজে। কিন্তু সে পরম আকাঙ্ক্ষিত মুক্তি কী দিতে পারে, কে দিতে পারে...?
শুধু মুসলিম নয়- সারা পৃথিবীর সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে জাগতিক মোহগ্রস্ততা। অবাধ তথ্যের যুগে আমরা বৈশ্বিক তরুণরা পরিণত হয়েছি বিভ্রান্ত, অস্থিরতাপ্রবণ আর পরিচয়হীন সত্তায়। ধর্মাচারের কথা যে গুটিকয় মানুষ আমাদের মনে করিয়ে দেয়- তা আমাদের কাছে অনেক কট্টর এবং কিঞ্চিৎ ইমপ্র্যাক্টিকাল মনে হয়। বছরের দুই ঈদসহ অন্যান্য ধর্মীয় ফেস্টিভ্যালগুলো তাদের পবিত্রতা হারিয়ে পুরোদস্তুর মজমাস্তি আর পার্টির উৎসবে পরিণত হয়েছে। এই পবিত্র দিনগুলোতে অনেক তরুণ তরুণী তাদের ভার্জিনিটি হারায়। মোটামুটি পুরো সেক্যুলার ওয়ার্ল্ডে এভাবেই চলছে...
এই পুরো ব্যাপারটা যদি সত্যিই সমস্যা হয়ে থাকে- তবে সমস্যার অনুধাবন হবে সমাধানের প্রথম ধাপ...। আমাদের অনেক প্রাজ্ঞ আলিম, চিন্তাবিদ আর সমাজকর্মী যারা আছেন, তাদের বর্তমান একবিংশ শতাব্দীর তারুণ্যের সমস্যাগুলো ধরিয়ে দেয়াটা কর্তব্য মনে করি। আশা করি এতে করে একসময় সমাধান উঠে আসবে...।
লিখেছেনঃ জাহিদ হাসান হৃদয়
সিয়ান | বিশুদ্ধ জ্ঞান | বিশ্বমান
0 Comments